প্রতিনিধি ৪ মে ২০২৩ , ৮:০৬:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি:
মানসিক ভারসাম্যহীন ২৭ বছর বয়সী শাহান আলী। প্রায় ২১ বছর ধরে পায়ে শিকল ও হাতে দড়ির বাঁধনে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। দিনের বেলায় বসতঘরের পেছনে খোলা আকাশের নিচে গাছের সঙ্গে ও রাতে ঘরের ভেতর খুঁটির সঙ্গে দুই হাতে ও দুই পায়ে শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়। সেখানেই চলে তার খাওয়াদাওয়া আর প্রস্রাব-পায়খানা। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলছে শাহানের বন্দিজীবন।
সে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার চণ্ডীগড় ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের থাপনারগাতি গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ মিয়ার ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে শাহান আলী ছোট। দুই পায়ে শিকল ও দুই হাতে দড়ির বাঁধন যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে তার। জন্মের ছয় বছর বয়স থেকেই পায়ে শিকল ও হাতে দড়ি বাঁধা হয়ে প্রায় ২১ বছর ধরে মানবেতর জীবন যাবন করছেন ওই যুবক। পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করিয়েও কোনো লাভ হয়নি বলে জানায় পরিবার। তবে অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা।
আজ (০৪ মে) বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বসতঘরের পেছনে খোলা আকাশের নিচে গাছের সঙ্গে দুই হাতে ও দুই পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীন শাহানকে। তাকে সারা দিন এখানেই বেঁধে রাখা হয় বলে জানান বাবা আব্দুল মজিদ আলী।
শাহান আলীর বাবা আব্দুল মজিদ আলী জানান, ১৯৯৬ সালের ১৩ নভেম্বর শাহান আলীর জন্ম। প্রায় ছয় বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই তার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয়। সে সময় তাকে ছেড়ে দিলে ছোটাছুটি করে যাকে সামনে পেত তাকেই মারধর করত। এলাকাবাসীর গরু, হাঁস-মুরগি, ছাগলকেও মারধর করাসহ পরিবারের লোকজনকেও কাছে পেলে আঘাত করার চেষ্টা করত। যতই বড় হচ্ছিল অস্বাভাবিক আচার-আচরণ, মারধর দিনদিন বাড়তে থাকে। পরে সামর্থ্য মতো কিছুদিন চিকিৎসা চালালেও সুস্থ হয়নি শাহান আলী। তার আচরণের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং দিন দিন বাড়তেই থাকে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বেঁধে রাখা হচ্ছে তাকে।
শাহানের মা রহিমা খাতুন বলেন, জন্মের পরদিনই শাহানের খিঁচুনি হয়। এরপর আমরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালে সুস্থ হলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় তার মধ্যে। বয়স যখন ছয় তখেই মানুষকে মারধর শুরু করে। বড় দুর্ঘটনাও ঘটিয়েছে। এ জন্যই তাকে রাতে ঘরের ভেতর খুঁটির সঙ্গে এবং সকালে বাড়ির সামনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে সেখানেই খাবার দেওয়া হয়।
তিনি কান্নায় জর্জরিত কণ্ঠে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে হাতে-পায়ে বেঁধে রেখেছি সন্তানকে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখায় হাতে ক্ষত হয়ে গেছে। এই দৃশ্য মা হয়ে সহ্য করতে পারছি না।
এলাকাবাসীদের একজন বলেন, ‘আমি ছোট থেকেই দেখে আসছি এ রকম শিকলে বাঁধা অবস্থায়। প্রস্রাব-পায়খানা এলে চিৎকার শুরু করে, পরে পলিথিন দিলে সেখানে পায়খানা করে, এরপর তার মা অথবা বাবা পরিষ্কার করেন। তার বাবা-মা সারা দিন এ ছেলের কথা ভেবে কান্নাকাটি করেন।
সরকারি সহায়তায় উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারত বলে জানায় তার পরিবার।