প্রতিনিধি ৩০ আগস্ট ২০২৩ , ১১:৪০:২৭ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
দেশে বাল্যবিবাহ দেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে নিম্নবিত্তের হার সর্বাধিক। তবে উদ্বেগজনকভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বাল্যবিবাহের হার প্রায় এক চতুর্থাংশ। আর বাল্যবিবাহরে শিকার ৭২ শতাংশ কন্যাশিশুর বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাজধানীর ফার্মগেটে ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে ‘বাল্যবিবাহের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত’ বিষয়ক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে আসে।
দেশের ৮টি বিভাগের ৩৭টি জেলা এবং সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায় থেকে মোট ২ হাজার ৬০ জনের নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ দেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে নিম্নবিত্তের হার সবচেয়ে বেশি। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও বাল্যবিবাহের হার প্রায় এক চতুর্থাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে শিক্ষাও এক্ষেত্রে বড় প্রভাব বিস্তার করে। বাল্যবিবাহ দেওয়া অভিভাবকদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ (২৬০ জন) নিরক্ষর, ৪১ শতাংশ (৩৪৭ জন) অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, ২৬ শতাংশ (২১৭জন) স্বল্প শিক্ষিত এবং ৪ শতাংশ (৩৩ জন) শিক্ষিত পরিবার রয়েছে।
জরিপে অভিভাবকদের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কন্যাশিশুরা সর্বাধিক বাল্যবিবাহের শিকার হয়, যা মোট বাল্যবিবাহের ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে বাল্যবিবাহের শিকার ৫৭ শতাংশ কন্যাশিশুর বিয়ে ১২-১৫ বছরের মধ্যে হয়েছে। শতকরা ৫৬ শতাংশ অভিভাবক বাল্যবিবাহের আইন সম্পর্কে জানার পরেও আইন অমান্য করে নানাভাবে তাদের কন্যাশিশুর বিয়ে দিয়েছেন। এ বিয়েগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ বিয়েই নিবন্ধন ছাড়া হয়েছে। বিয়ের সময় কাজীকে জন্মসনদ দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও শতকরা ৫৪ শতাংশ অভিভাবক কাজীকে তার মেয়ের জন্মসনদ দেননি।
জরিপকালে শতকরা ৩৬ শতাংশ ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার জানিয়েছেন, সমাজে বাল্যবিবাহের হার মাত্র ১০ শতাংশ।
আর ৩ শতাংশ ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার বলেছেন, দেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ, যা সমাজের বাস্তব চিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সমীক্ষায় বাল্যবিবাহের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত হিসেবে নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গি ও কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা, বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কন্যার প্রতি দায়িত্ব পালন, বাল্যবিবাহের ফলে কন্যাশিশুর ওপর আসা অভিঘাত সারাজীবন বয়ে বেড়ানো, মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া, স্বাস্থ্য অধিকার ক্ষুণ্ণ এবং জীবনভর নির্যাতনের শিকার হতে থাকা, বাল্যবিবাহ বিষয়ক তথ্যের অভাব এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কাজের পরিবীক্ষণ না করা মিথ্যা সনদপত্র প্রদান করা; বাল্যবিবাহের সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বহীনতা এবং জবাবদিহিতা সর্বোপরি সুশাসনের অভাব; বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার বড় প্রতিফলন; আইন থাকা সত্ত্বেও এই দায়িত্বহীনতা অপরাধ হিসেবে গণ্য না হওয়া; মিথ্যা জন্মসনদ দিয়ে বিয়ে সম্পন্নকারীদের আইনের আওতায় না নিয়ে আসা; কন্যাশিশুর গর্ভকালীন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা; দেশের অর্থনীতি অর্ধেক মানব সম্পদের শ্রমশক্তি থেকে বঞ্চিত করা; এছাড়া অর্থনৈতিক অবস্থানের সাথে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক রয়েছে।
এ অবস্থায় সমাজে কন্যাশিশুর নিরপত্তাহীনতা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে গুরুত্বপূর্ণদিক হিসেবে উপস্থাপন করে এ প্রেক্ষিতে কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আব্দুল আজিজ বলেন, অনেক আইন থাকলেও বাস্তব অবস্থার কারণে তা প্রয়োগ করা যায় না। গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্রদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। বংশানুক্রমে কাজীর ছেলে কাজী হয়, এটা বন্ধ করা গেলে বাল্যবিবাহ বন্ধে সুফল আসত। কাজীরা তাদের সুযোগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জোরালো ভূমিকা পালনে জনপ্রতিনিধিদের তৎপর হতে হবে। কিশোরী ক্লাবগুলোর মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোরীদের সচেতন করতে হবে।
এসময় তিনি বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোর-কিশোরী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ও সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানান।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাল্যবিবাহের প্রবণতায় জেলাভিত্তিক কোন পার্থক্য আছে কিনা এটা মূল রিপোর্টে আনা যেতে পারে। পালিয়ে বিয়ে করায় বাল্যবিবাহ বাড়ছে –এটাকে জনপ্রতিনিধিদের অজুহাত হিসেবে দেখানো বন্ধ করতে হবে। বাল্যবিবাহ দিলে কন্যা উপবৃত্তি পাবেনা এমন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে কিশোরী ক্লাব মনিটরিং করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি দূর করতে সরকারি সংস্থাকে উদ্যোগ নিতে হবে।
অ্যাম্বাসি অব সুইডেন, বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার রেহানা খান বলেন, বাল্যবিবাহের মূল কারণগুলো এ সমীক্ষায় সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বাল্যবিবাহ একটি অভিশাপ আমরা জানি। কন্যাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি। নারী ও কন্যাদের সিদ্ধান্ত ও পছন্দের সুযোগ কম, সেটিও দূর করতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে আছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহুমুখী পদক্ষেপ থাকা শর্তেও কেন বাল্যবিবাহ বাড়ছে এবং বাল্যবিবাহের কারণে তৈরি হওয়া অভিঘাতগুলোকে সমাজ কিভাবে দেখছে তা পর্যালোচনার জন্য আজকের সভার আয়োজন।
সভাপতির বক্তব্যে মাহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কিশোরীরা ভূমিকা পালন করছে। তবে তা অত্যন্ত সীমিত। শিক্ষার মান উন্নত করার সাথে সাথে শিক্ষাকে পণ্য হওয়া থেকে মুক্ত করে একটি মানবিক শিক্ষা কিশোর কিশোরীদের দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের সাথে তার সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া জোরালো ভূমিকা পালন করে। নারীর রাজনীতিতে অধিকার, সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার এবং নারীর অবৈতনিক গৃহশ্রম বন্ধ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এই তিনটি বিষয় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আবশ্যক। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের সাথে সাথে বাল্যবিবাহ বন্ধে বহমান সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ কাজ করতে হবে।