ড. আশেক মাহমুদ ১০ অক্টোবর ২০২৪ , ৩:৪৩:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি। এত বেশিসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কি উচ্চমানে উন্নীত হতে পেরেছে? বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে উন্নীত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও সরকারের ভূমিকা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এবারের গণআন্দোলন ও নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার হবে এই প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার সূতিকাগার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। সেই জায়গা থেকে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবি আসবে সবার আগে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছার আগে সমস্যা চিহ্নিত করা জরুরি।
সমস্যাটা দীর্ঘকাল ধরে জিইয়ে রাখা রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড এই ধারণাকে পাকাপোক্ত করেছে যে, চলমান ছাত্র রাজনীতির বিলোপ না হলে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। তখনই ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত। তাদের দাবি যেমন ছিল আবরার হত্যার বিচার, তেমনি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর কাঠামোগত সংস্কার। প্রভাবশালী ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতির নামে হলগুলোকে টর্চার সেলে পরিণত করেছিল। কলমের শাসন ছিল না, ছিল অস্ত্রের শাসন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক দলের মিছিলে যেতে বাধ্য ছিল, র্যাগিংয়ের শিকার হতো প্রতিনিয়ত। হলগুলোতে বিস্তৃত হয়েছিল ভয়ের সংস্কৃতি। অত্যাচার আর নিপীড়ন ছিল অবর্ণনীয়। অনেকে ছাত্র রাজনীতি করত দলীয় পরিচয় দিয়ে চাকরি লাভের আশায়। লেখাপড়ার চেয়ে দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে তাদের ছিল অধিক মনোযোগ। এমন বেদনাদায়ক ও বৈষম্য চর্চার পরিবেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা মুক্তির পথ খুঁজছিল।
সেই চিন্তা থেকে ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকায় ‘উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে করণীয় কী’ এ বিষয়ে আমার লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই নিবন্ধে আমি উল্লেখ করেছি, ‘উচ্চশিক্ষালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাসংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে একটা মানে দাঁড় করাতে হলে ভালো মানের ব্যবস্থাপনা থাকতেই হবে। এটাকেই আমরা শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতি বলতে পারি। শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতিকে আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে মুক্ত করা যেমন জরুরি, তেমনি দরকার রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য। শিক্ষা ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে হল কাঠামোয় চলমান পদ্ধতি বাতিল করলেই হবে না, প্রশাসনিক সংস্কার আনতে হবে।’
হল কাঠামোয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। সেই সংস্কৃতির স্থলে রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য বিনির্মাণ অত্যাবশ্যক। এমন অত্যাবশ্যকীয় কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কি মনোযোগী হয়েছে? এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা জরুরি।
তবে সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ আমাদের মর্মাহত করেছে। অল্প কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের কমিটি ঘোষিত হয়েছে। কমিটি ঘোষণার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকের মধ্যে উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এই উচ্ছ্বাস কি গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? ছাত্ররা তো শুধু ছাত্রলীগমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চায়নি, তারা চেয়েছিল রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন। হয়তো অনেকে বলবেন, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি থাকুক; থাকুক সুস্থ রাজনীতি। ছাত্র সংসদ পদ্ধতি চালু হলে সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবেÑ হয়তো এমনটা ভাবছেন কেউ কেউ। পুরনো ছাত্র রাজনীতি চালু রেখে ছাত্র সংসদ পদ্ধতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা কি সম্ভব? আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য থাকা দরকার।
শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতি যেন কোনোভাবেই কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়, সেদিক নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতিতে সাদাদল, নীলদলের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এমনই করে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির নামে দলীয় ক্যাম্পাস-রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এর মানে কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো অঙ্গসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকবে না। তবে শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতি থাকবে। শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতি তখনই স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যতা লাভ করবে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার, প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, হলের হাউজ টিউটর এমনকি ডিনসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগ হবে একাডেমিক যোগ্যতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এর নাম হতে পারে, ম্যারিটোক্রেটিক ডেমোক্রেসি (গবৎরঃড়পৎধঃরপ উবসড়পৎধপু) বা মেধাভিত্তিক গণতন্ত্র।
তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবক পরিষদ থাকবে। অভিভাবক পরিষদ নির্বাচিত হবে শিক্ষকদের ভোটে। কোনো দলীয় ইমেজে কেউ প্রার্থী হবেন না। প্রার্থীকে ন্যূনতম অধ্যাপক হতে হবে, থাকতে হবে নির্দিষ্টসংখ্যক ইম্প্যাক ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেল ও বই। প্রতিটি অনুষদ থেকে নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে অভিভাবক পরিষদ।
সেই অভিভাবক পরিষদের দায়িত্ব হবে সিনেট বা শিক্ষক সংসদ পরিচালনা করা। সিনেট থেকে নির্বাচিত হবে ভিসিসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ। প্রতিটি পদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকবে, যেন যোগ্য শিক্ষকরাই নির্বাচিত হতে পারেন। যোগ্য শিক্ষকরা প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেবেন। শিক্ষক নিয়োগে এবং পদোন্নতিতে যোগ্যতার ন্যূনতম মাপকাঠি এমন হতে হবে, যেন সবচেয়ে মেধাবীরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। শিক্ষকদের অধিকারের জন্য শিক্ষক সমিতি থাকবে। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে কোনো দলীয় পরিচয় থাকবে না। ব্যক্তি পরিচয়ে এবং শিক্ষক নিজের সিভির মান তুলে ধরে ভোট চাইবেন। সেই শিক্ষক সমিতির মূল পদাধিকারী শিক্ষকরা সিনেটের সদস্য হতে পারবেন। কোনো সচিব শিক্ষক সংসদ বা সিন্ডিকেটের সদস্য হতে পারবেন না। প্রতিটি হলের হাউজ টিউটর এবং হল প্রভোস্ট শিক্ষক সংসদে প্রতিটি হলের সমস্যা তুলে ধরবেন, যেন সমস্যা উত্তরণে অভিভাবক পরিষদ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
শিক্ষক সংসদের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছাত্র সংসদ পদ্ধতি চালু করতে হবে। কেন্দ্রীয় রাজনীতির অঙ্গসংগঠন যদি ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার সুযোগ পায় তাহলে ছাত্র সংসদ পদ্ধতিতে স্বকীয়তা বজায় রাখা যাবে না। কেন্দ্রীয় রাজনীতির অঙ্গসংগঠন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে, তাহলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে কীভাবে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করবেন? হয়তো এখন অনেকে বলবে, আমরা চাই প্রশাসন তার কাজ চালিয়ে যাবে, তাহলে ছাত্র রাজনীতি করলে সমস্যা কী? সমস্যা হবে তখনই যখন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে। কোনো ছাত্র বা শিক্ষক নাগরিক হিসেবে রাজনীতি করতে পারবে, তবে তা হবে ক্যাম্পাসের বাইরে। কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কেউ রাজনীতি করলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন রাজনীতি করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে তখন সামন্তবাদ থেকে রক্ষা করা যাবে না।
হলগুলোকে সামন্তবাদী দখল থেকে রক্ষা করতে হলে কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সক্রিয়তা নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাবিষয়ক রাজনীতিতে সৎ ও মেধাবীদের রাজনীতি চালু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য ছাত্র উন্নয়ন সংগঠন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রকল্যাণ সংগঠন, শিক্ষাবান্ধব ছাত্রকল্যাণ সংগঠন, গণতান্ত্রিক ছাত্র অধিকার সংগঠন ইত্যাদি নামে অরাজনৈতিক সংগঠন চালু করতে পারে। এসব দল বা সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে মেধাতালিকায় ১ম থেকে দশম হতে হবে। তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি সিনেটের সদস্য হতে পারবে। একই পদ্ধতিতে প্রতিটি হলের হল প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। প্রতিটি হলের নির্বাচিত হল প্রতিনিধি হল পরিচালনার ক্ষমতা পাবে না। হল প্রতিনিধি হল প্রভোস্ট এবং হলের হাউজ টিউটরদের সঙ্গে মিটিং করে দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারবে। হল পরিচালনার ক্ষমতা বাস্তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের হাতেই রাখতে হবে। তা ছাড়া হলের ভিপি সিনেট সদস্য হিসেবে হলের সমস্যা সিনেটে তুলে ধরতে পারবে।
এমনই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সেজন্য অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উচ্চশিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে। উচ্চশিক্ষা সংস্কার কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করবেÑ যেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতির চর্চা না হতে পারে, যেন সামন্তবাদী প্রশাসন গড়ে না ওঠে, যেন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা